SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান - দুর্যোগের সাথে বসবাস | NCTB BOOK

Tsunami জাপানি শব্দ। ‘সু’ অর্থ বন্দর এবং ‘নামি' অর্থ ঢেউ। সুতরাং সুনামি অর্থ হলো বন্দরের ঢেউ। এটি একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সমুদ্রতলদেশে ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিধস এবং নভোজাগতিক ঘটনা সুনামি সৃষ্টি করতে পারে। সুনামিকে পৃথিবীর তৃতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মহাসাগর এবং সাগরের তলদেশের প্লেট যখন একটির সাথে আরেকটির সংঘর্ষ হয়ে বিচ্যুত হয়, তখন সেখানে প্রচণ্ড ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়। সেই ভূমিকম্পের কারণে লক্ষ লক্ষ টনের সমুদ্রের পানি বিশাল ঢেউ তৈরি করে (চিত্র ৯.০৭)। এই ঢেউ ধাবমান হয়ে যত বেশি তীরভূমির কাছাকাছি যায়, তত দীর্ঘ হয়ে ভয়ঙ্কর জলোচ্ছ্বাসে রূপ নেয়। এই ঢেউয়ের গতিবেগ ঘণ্টায় ৫০০ থেকে ৮০০ মাইল পর্যন্ত হতে পারে। খোলা সমুদ্রে এই ঢেউয়ের উচ্চতা মাত্র দুই থেকে তিন ফুট পর্যন্ত থাকে। কিন্তু ঢেউ যতই তীরের দিকে এগিয়ে যায়, ততই তার উচ্চতা বাড়তে থাকে। তখন ঢেউয়ের এক মাথা থেকে আরেক মাথার দূরত্ব ১০০ মাইল পর্যন্ত হতে পারে, অগভীর পানিতে সুনামি একটি ধ্বংসাত্মক জলোচ্ছ্বাসে রূপ নেয়। অগ্রসরমাণ জলরাশি ভয়ঙ্কর স্রোত সৃষ্টি করে নেমে যাওয়ার আগে ১০০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। একটি সুনামি উপকূলের ব্যাপক এলাকা প্লাবিত করতে পারে।


সাধারণত সমুদ্রের তলদেশে একটা ভূমিকম্প হলে সুনামি তৈরি হয়। ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে শুরু করে সমুদ্র অতিক্রম করে সুনামিকে উপকূলে পৌঁছাতে খানিকটা সময়ের প্রয়োজন। এই সময়টুকুর ভেতরে সাধারণত উপকূল এলাকায় সতর্কবাণী প্রচার করা হয়। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর স্মরণকালের ভয়ঙ্কর একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের কাছাকাছি ভারত মহাসাগরের তলদেশে সৃষ্টি হয়েছিল ট্রাক্টনিক ভূমিকম্প। ইউরেশিয়ান প্লেট ও অস্ট্রেলিয়ান প্লেটের সংঘর্ষে সৃষ্টি হওয়া এই মারাত্মক ভূকম্পনটি ছিল রিখটার স্কেলে নয় মাত্রার। এই ভূকম্পনের ফলে ভারত মহাসাগরের একাংশ সুমাত্রার অন্য একটি অংশকে সজোরে চাপ দেয়। এই প্রবল চাপে সমুদ্রতলের ৬০০ মাইলব্যাপী এলাকায় ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এই ভাঙনের ফলে স্থানচ্যুতি ঘটে লক্ষ লক্ষ টন জলরাশির। বিশাল জলরাশি ভয়ানক বেগে সমুদ্রপৃষ্ঠের দিকে ধেয়ে আসে এবং বিশাল ঢেউয়ের আকারে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই ঢেউ মহাপ্লাবনে রূপ নিয়ে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারত, থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ প্রভৃতি দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়া ছাড়িয়ে কেনিয়া, সোমালিয়াসহ ১২টি আফ্রিকান দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। জলোচ্ছ্বাসে তিন লাখের মতো মানুষ নিহত হয়। শুধু ইন্দোনেশিয়ায় সুমাত্রার আচেহ প্রদেশেই নিহত হয়েছে এক লাখ মানুষ। তারপর বেশি লোক নিহত হয়েছে শ্রীলঙ্কায়। সুনামির জলোচ্ছ্বাসে ভারত মহাসাগরের বহু ছোট ছোট দ্বীপ সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এসব দ্বীপে বসবাসকারী বহু আদিবাসী গোষ্ঠী প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডবে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে শিশু ও নারী, মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে হাজার হাজার মানুষ। ভূতত্ত্ববিদ ও সমুদ্র বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই সুনামির তীব্রতা এতটাই প্রবল ছিল যে পৃথিবী তার অক্ষে ঘুরতে ঘুরতে কিছুটা নড়ে যায়। এছাড়া ভূকম্পনের ফলে যে বিপুল পরিমাণ শক্তির বিকিরণ হয় সেটি ছিল সাড়ে নয় হাজার পারমাণবিক বোমার সমান ক্ষমতাসম্পন্ন। সমুদ্র তলদেশে ব্যাপক ভাঙনের ফলে এতদিনকার ভারত মহাসপারের সমুদ্রপথের দিকনির্দেশনার মানচিত্রটি পর্যন্ত এলোমেলো হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নতুন করে ভারত মহাসাগরে নৌচলাচলের মানচিত্র তৈরি করতে হবে; নইলে ভবিষ্যতে জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটতে পারে।

২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বরের সুনামিতে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হয়নি। অগভীর পানিতে যাওয়ার সময় সুনামি তার শক্তি হারায়। বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরে ১৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত অগভীর পানি এবং এই অগভীর পানি বাংলাদেশকে সুনামির কবল থেকে রক্ষা করে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর চেয়ে সুনামিতে বাংলাদেশের ক্ষতি সামান্য। শুধুমাত্র কুয়াকাটার সমুদ্র উপকূলে সে সময় মাছ ধরা ট্রলার ডুবে দুজন জেলে মারা গিয়েছিল। ১৭৬২ সালের ২ এপ্রিল বঙ্গোপসাগরের আরাকান অঞ্চলে সংঘটিত একটি ভূমিকম্প থেকে সৃষ্ট সুনামি বাংলাদেশে আঘাত হেনেছিল। তখন কক্সবাজার এবং পার্শ্ববর্তী দ্বীপসমূহে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। এর প্রভাবে ঢাকার বুড়িগঙ্গায় পানি হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার যে ঢেউরের সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে শত শত নৌকা ডুবে বহু লোক প্রাণ হারিয়েছিল।

 

Content added By